২৯ বছর সন্তানের স্বীকৃতির অপেক্ষা শেষ হলো রাজশাহীর পুঠিয়ার জুয়েল মন্ডলের। এ নিয়ে ১৪ বছরের বেশি সময় ধরে চলেছে আইনি লড়াই। সেই লড়াইয়ে জয়ী হলেন জুয়েল। হাইকোর্টের এক রায়ে সন্তান হিসেবে রফিকুল ইসলাম জুম্মাকে ‘বাবা’ ডাকার অধিকার পেলেন তিনি। একইসঙ্গে পাচ্ছেন বাবার খোরপোশ। গতকাল বুধবার বিচারপতি এস এম মজিবুর রহমানের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ এ সংক্রান্ত রুল আংশিক যথাযথ ঘোষণা করে এ রায় দেয়।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা বলছেন, উচ্চ আদালতের রায়ে আড়াই দশকের বেশি সময় পর মা-ছেলে দুজন পাচ্ছেন পারিবারিক ও সামাজিক মর্যাদা। পূর্ণাঙ্গ রায় পেলে আদালতের আরও কী আদেশ ও পর্যবেক্ষণ থাকে তা আরও বিস্তারিত জানা যাবে। তবে বিবাদীপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি পেলে আপিল করা হবে।
২৯ বছর বয়সী জুয়েল মন্ডল এখন স্থানীয় এলাকায় রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। পাশাপাশি নাটোরের একটি কলেজে বিএ পড়ছেন। তার মা আয়না বেগম প্রায় আট বছর আগে মালয়েশিয়া যান। সেখানে গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। আর রফিকুল ইসলাম জুম্মা (৫৫) পুঠিয়ার স্থানীয় একটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে এসএসিএমও (সাব অ্যাসিসটেন্ট কমিউনিকেট মেডিকের অফিসার) হিসেবে কর্মরত। ইতিমধ্যে তিনি বিয়ে করেছেন এবং এক ছেলে ও মেয়ের জনক। ভুক্তভোগী জুয়েল মন্ডলকে আইনি সহায়তা দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটি। কমিটির প্যানেলের আইনজীবী হিসেবে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট চঞ্চল কুমার বিশ^াস। রফিকুল ইসলাম জুম্মার পক্ষে ছিলেন আইনজীবী শাহেদ আলী জিন্নাহ।
মামলার নথি ও সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য অনুযায়ী, ৩০ বছর আগে রাজশাহীর পুঠিয়ার বিলমাড়িয়া এলাকায় প্রতিবেশী রফিকুল ইসলাম জুম্মার বাসায় যাতায়াত ছিল একই এলাকার আয়না বেগমের। ওই বাসায় টিভি দেখা ও তাদের নানা কাজে সহযোগিতা করতেন হতদরিদ্র আয়না। একপর্যায়ে বিয়ের আশ^াস ও নানা প্রলোভন দেখিয়ে আয়না বেগমের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন জুম্মা।
নথির বরাত দিয়ে আইনজীবীরা জানিয়েছেন, ১৯৯২ সালের ২১ ডিসেম্বর দুজনের বিয়ে হলেও সেটি হয় কোনো দালিলিক প্রমাণ ছাড়া। ১৯৯৩ সালের ১ নভেম্বর আয়না বেগমের কোলজুড়ে আসে এক শিশু। কিন্তু তা অস্বীকার করেন জুম্মা। প্রতিকার পেতে ২০০৮ সালের ১৬ জানুয়ারি রাজশাহীর পারিবারিক আদালতে দেনমোহর ও সন্তানের ভরণ-পোষণ পেতে মামলা করেন তিনি। তবে, সমনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের এপ্রিলে আদালতে যে জবাব দেন রফিকুল ইসলাম তাতে তিনি মামলার সব বিষয়বস্তু অস্বীকার করেন। শুনানি শেষে ২০১০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পারিবারিক আদালত আয়না বেগমের আবেদন খারিজ করে রায় দেয়। এতে বলা হয়, ‘জুম্মা ও আয়নার বিয়ে প্রমাণিত হয়নি। সাক্ষীরা বিশ^াসযোগ্যভাবে কোনো সাক্ষ্য উপস্থাপন করতে পারেননি। বৈধ সন্তান প্রমাণিত না হওয়ায় বাদীপক্ষ প্রতিকারের হকদার নয়।’
এরপর পারিবারিক আদালতের এ রায়ের বিরুদ্ধে রাজশাহীর সংশ্লিষ্ট যুগ্ম জেলা জজ আদালতে আপিল করেন আয়না বেগম। ২০১১ সালের ২৭ মার্চ সেই আপিলটিও খারিজ হয়ে গেলে পারিবারিক আদালতের রায়টি বহাল থাকে। ছয় বছর পর ২০১৭ সালে প্রতিকার পেতে হাইকোর্টের দারস্থ হন আয়না বেগম। কিন্তু কায়ক্লেশে চলা দুজনের পক্ষে মামলা পরিচালনার মতো সংগতি ছিল না। আইনি সহায়তা পেতে সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির দারস্থ হন তিনি। বিচারিক আদালতের রায় চ্যালেঞ্জ করে আবেদন করা হয় উচ্চ আদালতে। শুনানি নিয়ে এই মামলার ক্ষেত্রে কেন তামাদি মওকুফ করা হবে না তা জানতে চেয়ে ২০১৭ সালের নভেম্বরে রুল দেয় হাইকোর্ট।
শুনানি নিয়ে ২০২০ সালের ১২ নভেম্বর রুল যথাযথ ঘোষণা করে রায় দিলে তামাদি সংক্রান্ত জটিলতা দূর হয়। এরপর বিচারিক আদালতের ওই রায় চ্যালেঞ্জ করে নিয়মিত সিভিল রিভিশন আবেদন করা হয় হাইকোর্টে। গত বছরের ৬ জুন হাইকোর্ট বিচারিক আদালতের ওই রায় বাতিল প্রশ্নে রুল দেয়। রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে গতকাল এ রায় হলো। রায়ে রুল আংশিক যথাযথ ঘোষণা করে হাইকোর্ট রাজশাহী বিচারিক আদালতের ওই রায় বাতিল করে দেয়। রায়ের বরাতে অ্যাডভোকেট চঞ্চল কুমার বিশ^াস দেশ রূপান্তরকে বলেন, তাদের বিয়ে (রফিকুল ইসলাম জুম্মা ও আয়না বেগম) বৈধ এবং জুয়েল মন্ডল রফিকুল ইসলাম জুম্মার সন্তান হিসেবে খরপোশ এবং স্ত্রী হিসেবে আয়না বেগম দেনমোহর পাবেন। তবে, দেনমোহরের বিষয়টি সংশোধন করে দেবে হাইকোর্ট। তিনি আরও বলেন, ‘হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী জুয়েল মন্ডলের জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ সব সনদে বাবার নামের জায়গায় রফিকুল ইসলাম জুম্মার নাম রয়েছে। বিচারিক আদালত যে যুক্তিতে দুজনের বিয়ে বাতিল বলে ঘোষণা করেছিল হাইকোর্ট সেসব যুক্তি আমলে নেয়নি।’
হোম | যোগাযোগ | গোপনীয়তার নীতি | শর্তাবলী
All Rights Reserved By PM LLC © 2020 To Present - Development By Rumel Ahmed